শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০১:৪৮ অপরাহ্ন

অতলে তলিয়ে যাচ্ছে শ্রীলংকা

অতলে তলিয়ে যাচ্ছে শ্রীলংকা

চিররঞ্জন সরকার:

শ্রীলংকায় এখন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। একদিকে চরম আর্থিক সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি; অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভ। দেশজুড়ে নজিরবিহীন বিক্ষোভের মুখে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে অবশেষে পদত্যাগ করেছেন। একই দিনে শ্রীলংকায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর পর ক্ষমতাসীন দলের এক আইনপ্রণেতার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। সহিংসতা বন্ধে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেছে শ্রীলংকার পুলিশ। কিন্তু সংকট সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিরোধীরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, রাজাপাকসে পরিবারের কারও সঙ্গে তারা ক্ষমতা ভাগাভাগিতে যাবেন না। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের এখন ত্রিশঙ্কু দশা। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা তার জন্য যেমন কঠিন, ঠিক তেমনি ক্ষমতা ছেড়ে দিলে শুধু রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নয়; পুরো পরিবারের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।

শ্রীলংকা মানেই তো আমাদের চোখে ভেসে ওঠে বিদেশি পর্যটকে ঠাসা সমুদ্রসৈকত, ঝাঁ-চকচকে কলম্বো বা গলের রাস্তায় উদ্দাম নিশি উদ্যাপন, চীনা সংস্থাগুলোর ঝলমলে বহুতল ও কালো মসৃণ মেটাল রোডে লম্বা লম্বা বহুমূল্যবান গাড়ি। কয়েকদিনেই বদলে গেল ছবিটি। রাস্তাঘাটে আলো জ্বালানোর মতো বিদ্যুৎ নেই দেশটায়। গৃহস্থের ঘরে রান্না করার গ্যাস নেই। লোকের আলমারিতে প্রচুর টাকা থাকলেও বাজারে মিলছে না পণ্য। বড় বাড়ি ও গাড়ির মালিকও খাদ্যের অভাবে একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত ও সুন্দর দ্বীপরাষ্ট্রটিতে কীভাবে এমন আর্থিক সংকট নেমে এলো, তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। কীভাবে ব্রিটিশরা ছোট এ দ্বীপরাষ্ট্রটির কৃষি কাঠামো বদলে সেটিকে শুধু চা, কফি, রাবার ও মসলা উৎপাদনের জন্য উপযোগী করেছিল- ওই কাহিনি আপাতত বাহুল্য। ঔপনিবেশিক শাসকরা ইউরোপের বাজারে চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে তামিল শ্রমিকদের নিয়ে গিয়ে শ্রীলংকায় বাগিচা চাষের পত্তন ঘটিয়েছিল। স্বাধীনতার পরও শ্রীলংকা ওই ঔপনিবেশিক আর্থিক জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। আজও দেশটির অর্থনীতি থেকে গেছে মূলত চা, কফি, রাবার ইত্যাদি কৃষিপণ্য রপ্তানিনির্ভর। এর সঙ্গে পরে যুক্ত হয়েছে বস্ত্র। ইউরোপ ও আমেরিকার বড় বড় শপিংমলে এখন দেখা যায় শ্রীলংকার তৈরি জামাকাপড়। চাল-ডাল থেকে শুরু করে অন্য খাদ্যশস্য, গুঁড়া দুধ, নানা শিল্পজাত পণ্যের জন্য শ্রীলংকাকে নির্ভর করতে হয় আমদানির ওপর। বিদেশি মুদ্রা আয়ের বড় সূত্র হিসেবে ইদানীং যুক্ত হয়েছে পর্যটনশিল্প। ইউরোপ ও আমেরিকার পর্যটকরাই এখন শ্রীলংকার বিদেশি মুদ্রা আয়ের মূল ভরসা। বিদেশি এই মুদ্রা শ্রীলংকার অর্থনীতিকে সঞ্জীবিত রেখেছে।

শ্রীলংকার আর্থিক সংকটের শুরু খুঁজতে গেলে অবশ্য পিছিয়ে যেতে হবে ছয়ের দশকে। তখনো প্রায় একই ধরনের সংকটের মুখে পড়েছিল দেশটি। আইএমএফের বিশাল ঋণ নিয়ে ওই যাত্রায় সংকট কেটেছিল। সাতের দশকে শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষামূলক প্রকল্প উন্নয়নের অর্থনীতি নজর কেড়েছিল। শ্রীলংকার বিনামূল্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি কর্মসূচির প্রশংসা বারবার অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদের লেখায় তখন দেখা যেত। সামাজিক সুরক্ষা সাধারণ শ্রীলংকাবাসীর জীবনযাত্রা মানের বিপুল উন্নতি ঘটিয়েছিল। বাম ঘেঁষা বন্দরনায়েকের সরকার পড়ে যাওয়ার পর অবশ্য শ্রীলংকা জেআর জয়বর্ধনের হাত ধরে দেখেছিল দক্ষিণপন্থি রাজনীতির উত্থান। সেখানে হাতিয়ার হয়েছিল সিংহলি জাতীয়তাবাদ। এর বিপ্রতীপে তামিল ইলমের দাবি নিয়ে আবির্ভাব হয় প্রভাকরণের সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির। ১৯৮৩ থেকে টানা ২০০৯ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ দেখেছে শ্রীলংকা। ওই সময় যাবতীয় সংকটের জন্য তামিল জঙ্গি তথা এলটিটিইর সন্ত্রাসকেই দায়ী করে এসেছে দ্বীপরাষ্ট্রটি। তবে শ্রীলংকার বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে অনেক ঘটনার প্রভাব রয়েছে।

২০১৯ সালের এপ্রিলে কলম্বোর একাধিক চার্চ ও হোটেলে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে- যাতে মৃত্যুসংখ্যা ২৫০ ছাপিয়ে যায়। এ ধারাবাহিক বিস্ফোরণই এক ধাক্কায় কলম্বোয় বিদেশি পর্যটক ৭১ শতাংশ কমিয়ে দেয়। ২০১৯ সালজুড়ে ধারাবাহিকভাবে দ্বীপরাষ্ট্রে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কমতে থাকে। ২০২০ সালের করোনা মহামারী পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে। ২০১৮ সালে শ্রীলংকা যেখানে পর্যটন থেকে ৪৪০ কোটি ডলার আয় করেছিল, ২০১৯ সালে সেটি নেমে আসে ৩৬০ কোটি ডলারে। ২০২০ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬ কোটি ৮২ লাখ ডলারে। ২০২১ সালে তা কমতে কমতে এসে ৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। একদিকে বিদেশি মুদ্রার জোগান কমছে, অন্যদিকে ঋণের ভার ও আমদানির খরচ বৃদ্ধির জন্য বিদেশি মুদ্রার চাহিদা বাড়ছে। এতে তৈরি হয়েছে এক অভূতপূর্ব সংকট।

২০১৯ সালের নভেম্বরে ভোটের আগে গোতাবায়া রাজাপাকসে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেন, ভোটে জিতলে কর কমাবেন এবং কৃষকদের নানা রকম ছাড় দেবেন। ভোটে জেতার পর রাজাপাকসে দেশে ভ্যাটের হার ১৫ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করে দেন। সব পণ্য পরিষেবার ওপর শ্রীলংকা ২ শতাংশ ‘নেশন বিল্ডিং ট্যাক্স’ গ্রহণ করত। সেটিও তিনি তুলে দেন। শেয়ারবাজারের মূলধনী আয়ের ওপর করের হারও কমানো হয়। সব মিলিয়ে রাজাপাকসের করনীতি ভাঁড়ারে টান ফেলে। অন্যদিকে বিদেশি মুদ্রার সংকট আমদানিতে প্রভাব ফেলে। কোভিড সংকটে সরকারের খরচও বেড়ে যায়। কোষাগার ঘাটতি জাতীয় উৎপাদনের ১০ শতাংশ ছাড়ায়। আমদানি খরচ কমাতে গিয়ে রাজাপাকসে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দ্রব্য আমদানি নিষিদ্ধ করে দেন। ২০২১ সালে তিনি ঘোষণা করেন, দেশের সব চাষ হবে জৈব সার দিয়ে। উন্নত দেশগুলোয় যেখানে চাষযোগ্য জমির মাত্র ৯ শতাংশ জৈব সারের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে রাজাপাকসে এক মাসের মধ্যে দেশের ১০০ শতাংশ কৃষিযোগ্য জমি জৈব সারের ওপর নির্ভরশীল করে দেন। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে গত কৃষি উৎপাদনে। ধান উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে যায়। কমে যায় চা-কফি উৎপাদনও। কৃষি উৎপাদনের পতন একদিকে খাদ্য সংকট, অন্যদিকে বৈদেশিক বাণিজ্যে সংকট তৈরি করে।

ধান উৎপাদন কমায় শ্রীলংকায় এখন চালের দাম ২২০ টাকা কেজিতে পৌঁছেছে। চিনি বিকোচ্ছে ২৪০ টাকা কেজিতে। নারিকেল তেলের দর ৮৫০ টাকা প্রতিকেজি। একটি ডিমের দাম ৩০ টাকা। বিদেশি মুদ্রা সংকটের জন্য সব আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দেশে পাওয়া যাচ্ছে না গুঁড়া দুধ, চিনি, নিউজপ্রিন্ট, ডিজেল ইত্যাদিসহ বিভিন্ন শিল্পজাত পণ্য। নিউজপ্রিন্টের সংকটে দেশে কাগজ বের হচ্ছে না। প্রশ্ন ছাপা যাচ্ছে না বলে স্কুল-কলেজে পরীক্ষা বন্ধ। ডিজেল সংকটের প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। রাস্তায় আলো জ্বলছে না। হাসপাতালে চিকিৎসা করা যাচ্ছে না। চলছে না এটিএম এবং মোবাইল ফোন। ফ্রিজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাছসহ কোনো পচনশীল খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। মিলছে না রান্নার গ্যাস। ফলে যাদের ঘরে চাল-ডাল আছে, তারাও রান্না করতে পারছেন না। সর্বার্থেই ভয়ঙ্কর অবস্থা।

শ্রীলংকার সংকটকে আরও ঘণীভূত করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ মহাজলোচ্ছ্বাসের মতো বৈশ্বিক অর্থনীতি ধ্বংসের মহাতরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। ওই তরঙ্গ কাছে-দূরের সব দেশকেই বিধ্বস্ত করছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অর্ধেক বিশ্ব দূরে থাকা শ্রীলংকার ওপর এর বড় অভিঘাত পড়েছে। খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ক্রমাগত দেশটিকে অর্থনৈতিক পতনের একেবারে তলায় নিয়ে ঠেকিয়েছে।

ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারের দুর্নীতি ও অযোগ্যতার ফলেই এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকারে শুধু তার নিজের পরিবারেরই সাত সদস্য স্থান পান। গোতাবায়ার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে হন শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী। তাদের দুর্নীতি, ক্ষমতা অপব্যবহারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ পুরো দেশকে অতলে ঠেলে দেয়। অথচ এই দেশ গত দশকে নিম্ন-মধ্যম থেকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল। মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৪ হাজার ডলারের বেশি। শিক্ষাব্যবস্থা গণমুখী, ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকার অদম্য তাগিদে পরিবারতন্ত্রের প্রাধান্য পাওয়া, মাত্রাছাড়া দুর্নীতির বহর, ঋণের অপব্যবহার, ভূরি ভূরি অবিবেচক সিদ্ধান্ত ও আইনের শাসনের চূড়ান্ত অপব্যবহার দেশটিকে আবার তলিয়ে দিচ্ছে। রাজাপাকসেদের অর্থ অপচয়ের বহরে চোখ বিস্ফারিত হবেই। চীনের ঋণে তৈরি হামবানটোটা বন্দর তৈরির পর দেখা গেল যথেষ্ট চাহিদাই নেই। ঋণ শোধে অপারগ শ্রীলংকা বাধ্য হয়েছে হামবানটোটা ৯৯ বছরের জন্য চীনকে লিজ দিতে। একই অবস্থা ‘চায়নিজ সিটি’সহ কয়েকটি বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পেরও। কোনোটিই আয়বর্ধক হয়ে ওঠেনি। কলম্বোর স্কাইলাইনের আকর্ষণ ‘লোটাস টাওয়ার’। দর্শনীয় হলেও অর্থনীতিতে এর কোনো অবদান নেই। ঋণ নিয়ে জমকালো কিছু করার প্রবণতায় অর্থনীতির অন্তর্জালি যাত্রার পথ যে প্রশস্ত হচ্ছে, রাজাপাকসেদের দৃষ্টিতে তা ধরা পড়েনি। টনক যখন নড়েছে, জল তখন বইছে নাকের ওপর দিয়ে। ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েছে দেশ। এক বছরের মধ্যে সুদ-আসলে শ্রীলংকাকে শোধ দিতে হবে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ। ঢাক ও মনসা একসঙ্গে বেচে দিলেও কুলাবে না। অবস্থা এমনই করুণ! আকণ্ঠ ঋণে জর্জরিত দেশটি আজ বিশ্বের কৃপাপ্রার্থী। বাংলাদেশ পর্যন্ত শ্রীলংকার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রীলংকাকে অর্থনৈতিক পতন ও আর্থরাজনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে আমূল সংস্কারমূলক পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ জন্য সবার আগে দরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য। আগামী দিনে নতুন কোনো প্রধানমন্ত্রী দেশের হাল ধরে আলোর দিশা দিতে পারেন কিনা, সেদিকে তাকিয়ে শ্রীলংকাবাসী।

চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877